স্বদেশ ডেস্ক:
মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের অধীন সরকারি তিন মুদ্রণালয়ের কর্মচারীদের ওভারটাইম অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে এ সংক্রান্ত গঠিত তদন্ত কমিটি। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সম্প্রতি কমিটি তাদের প্রতিবেদন পেশ করেছে। কেপিআইভুক্ত সরকারি এ তিন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী ইউনিয়ন বা ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঢালাওভাবে ওভারটাইম বন্ধ করার পক্ষে মতামতসহ ৯টি সুপারিশ তুলে ধরেছে কমিটি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা ওভারটাইম দেখিয়ে অবৈধভাবে বিল তোলার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিল দৈনিক আমাদের সময়। ‘কাগুজে ওভারটাইম : কাজ না করেই ২১ ঘণ্টার ডিউটি হাজিরা খাতায়’ শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি। ওই সংবাদের পর এমন অনিয়ম তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তিনটি প্রেসের উপপরিচালকের বক্তব্য- প্রেস সরেজমিন পরিদর্শন, রেকর্ড, নথিপত্র, প্রেমের সিসিটিভি ফুটেজ এবং এ সংক্রান্ত নির্দেশনা যাছাইয়ের মাধ্যমে রিপোর্ট তৈরি করে কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন মানুষের পক্ষে দৈনিক ৮ ঘণ্টার পাশাপাশি ১০-১৩ ঘণ্টা ওভারটাইমসহ ২০-২১ ঘণ্টা কাজ করানো মানবাধিকার পরিপন্থী ও গুরুতর অন্যায়। অতিরিক্ত ও নিয়মবহিভর্‚ত ওভারটাইম বন্ধসহ বেশ কিছু বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া সরকারি তিন মুদ্রণালয় অর্থাৎ গভর্নমেন্ট প্রিন্টিং প্রেস, বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয় (বিজি প্রেস) এবং বাংলাদেশ নিরাপত্তা মুদ্রণালয়ের বিষয়ে ৯টি সুপারিশও দিয়েছে তারা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনটি প্রেসেই প্রতিদিন ওভারটাইমে কাজ করানো হয়। এমনকি অধিকাংশ সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও প্রেস খোলা রেখে কাজ করানো হয় এবং ওভারটাইম দেওয়া হয়। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ডিউটির পর আরও ১২-১৩ ঘণ্টা ওভারটাইমসহ মোট কর্মঘণ্টা হয় ২০-২১ ঘণ্টা। এটি মানবাধিকার পরিপন্থী। এতে আরও বলা হয়েছে- তিন প্রেসে শুধু টেকনিক্যাল কর্মচারীদের অর্থাৎ ওভারটাইম ভোগী কর্মচারীদের নিয়ে কর্মচারী ইউনিয়ন থাকায় এটি একটি বিশেষ শ্রেণির কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষা করে। কর্মচারী ইউনিয়ন প্রেস কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং অপ্রয়োজনীয় ওভারটাইম এবং সরকারি ছুটির দিনে বুকিং দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে বলে প্রমাণ হয়েছে। প্রেসগুলোতে ওভারটাইমকালে কাজের তদারকি করার মতো পর্যাপ্ত কর্মকর্তা নেই। এ ছাড়া কাজ তদারকি করার কর্মকর্তারা ওভারটাইম ভাতার আওতাভুক্ত না হওয়ায় নির্ধারিত অফিস সময়ের পর তারা অফিসে থাকেন না। সব শাখার সব কর্মচারীকে একই সময় পর্যন্ত ওভারটাইম করানো যৌক্তিক নয়। তিন প্রতিষ্ঠানেই কর্মচারীদের আগমন ও প্রস্থানের সময় সঠিকভাবে রেকর্ড করা হয় না বলেও প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে ৯টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
সুপারিশগুলো হলো- ১. মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের অধীন তিনটি প্রেস করপোরেশনের মতো স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা নয় এবং এসব প্রতিষ্ঠানের সব কর্মচারী সরকারি চাকরিজীবী। এসব প্রতিষ্ঠানে শিফটিং প্রথা চালু নেই এবং কাজের প্রকৃতিও ভিন্ন। কর্মচারীরা শ্রম আইনের আওতাভুক্ত না হওয়ায় সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ওভারটাইম ভাতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি সুনির্দিষ্ট পরিপত্র জারি করা যেতে পারে।
২. প্রতিমাসে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিনসহ সর্বোচ্চ ওভারটাইমের সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। মাসিক সর্বোচ্চ ২৫০ ঘণ্টা ওভারটাইম ভাতা চালু করা যেতে পারে। ৩. প্রতিদিনের ওভারটাইম কাজের পরিমাণ ও প্রকৃতি অনুযায়ী নির্ধারণ করা যেতে পারে। ৪. শুধু সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য আবশ্যক জনবলকে ওভারটাইমের জন্য বুকিং দেওয়া যেতে পারে। ওভারটাইম ভাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট সরকারি আদেশ জারি করা যেতে পারে। ৫. প্রেসগুলোতে আধুনিক ও দ্রæতগতির মুদ্রণ ও মুদ্রণ সহায়ক যন্ত্রপাতি সংযোজিত হওয়ায় নতুন কেনা স্বয়ংক্রিয় মেশিনগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হালনাগাদ কর্মঘণ্টাভিত্তিক আউটটার্ন (উৎপাদন)-এর পরিমাণ নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী ওভারটাইম ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য বিষয় নির্ধারণ করা যেতে পারে। ৬. জরুরি প্রয়োজন না থাকলে সপ্তাহে প্রতিদিন একই সময় পর্যন্ত গড়ে ওভারটাইমের বিষয়টি বাদ দিতে হবে। ৭. সরকারি প্রেস তিনটি কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে সরকারের অতীত জরুরি, গোপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রণ কাজ চলে। কর্মচারী ইউনিয়ন কর্তৃক কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করার নজির থাকায় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্বার্থে এ ধরনের কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মচারী ইউনিয়ন বা ট্রেড ইউনিয়ন থাকা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। ৮. কর্মচারীদের কাজে যোগদান এবং অফিস ত্যাগের রেকর্ডের ভিত্তিতে ওভারটাম ভাতা প্রদান করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার লক্ষ্যে কর্মচারীদের হাজিরা ডিজিটালাইজড করা জরুরি। ৯. তদারককারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওভারটাইম ভাতার আওতাভুক্ত না থাকায় কার্যকর তদারকি নিশ্চিতে তাদের জন্য আর্থিক বা অন্য কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।